সেই বৃষ্টির বিকাল

আমি তখন বিছানায় শুয়ে, এই একটুখানি আগেই দুপুরের খাবারটা সেরে এসেছিলাম। খাবারের পরিমাণ টা বেশি হওয়ার ফলে ঘুম ধরছিল না যদিও রোজ এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি, সেদিন পড়িনি। বিছানা তেই ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, হঠাত মোবাইল টা হাতে নিয়ে ডাটা কানেকশন অন করতেই হোয়াট্স্যেপে ম্যাসেজ আসলো, "সুভ  কি করো?" আমি এইতো  প্রতিনিয়তর মতোই শুয়ে আছি। সে (মোহিনী) বলেছিল," আমি না আজ খুব বৃষ্টিতে ভিজেছি।" ওরে বাবা কি আজব ব্যাপার আজকে আমিও বৃষ্টিতে ভিজেছি।"আজ আসবে, অনেক দিন হলো তোমাকে দেখিনি।" সে বলেছিল। যদিও আমার মনে প্রবল আগ্রহ ছিল যে বলি তাকে তোমার কাছে যেতে পারবো এমন সৌভাগ্যের ব্যাপারটা কি ভাবে আমি অস্বীকার করি, তবে যেহেতু সেই মুহূর্ত টি আবেগীক হওয়ার ছিল না কারণ আমি জানি ও খুব ছেলেমানুষি করে জেদ করে অনেক ব্যপারেই কিন্তু তার মা তখন বাড়িতে ছিলোনা আবার এদিকে সেমিস্টারের পরীক্ষা সামনে ছিলো এরই মধ্যে যদি ওর শরীর খারাপ করে! এই অশুভ ফলাফল টার কথা মনে করেই আমি তাকে বলেছিলাম, " আজ থাক না অন্য একদিন দেখা হবে, দেখতেই তো পাচ্ছ কি অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হচ্ছে, ভিজলে তোমার শরীর খারাপ হতে পারে আর এদিকে মা ও নেই বাড়িতে।" ওই সময়েই হয়তো সে আমার প্রতি জীবনের সবচেয়ে প্রিয় উক্তিটি করেছিল যে, "আমার কিছু হবে না তুমি আছো না আমার সাথে, আসো না আজ দুজনেই একসাথে ভিজি।"  আমি ওকে প্রায়ই বলতাম, আমার খুব ইচ্ছে হয় তোমার জন্য বৃষ্টি হতে আর তোমার সারা শরীর ভিজিয়ে দিতে, কিন্তু সেদিন যখন সে আমায় তার জন্য বৃষ্টি হওয়ার সুযোগ দিতে চাইলো আমি বারবার অস্বীকার করছি দেখে সে খুবই অভিমানের সুর বললো "লাগবে না তোমার আসতে।" হঠাত করে মনে হলো যেন অনেক দেরি ধরে সাজানো খেলা ঘর নিমেষে ভেঙে চুরমার হলো। আমি তাকে কি বলবো বুঝতে না পেরে অবোধ এর মতো বলে উঠলাম " একটা গান গাইবে আমার জন্য" সে খুবই সহজ ভাবে উত্তর দিয়েছিল "না।"
সে যত সহজ ভাবে 'না' বলেছিলো ততটাই কঠিন ভাবে গুমরে গুমরে কেদে উঠছিল আমার বুকের ভেতরটা, কেমন যেন ফাঁপা কান্না আর আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে ওই সময়টা আমার কি করা উচিত।
কারণ আমি সত্যিই খুব বেশি চিন্তিত ছিলাম ওর স্বাস্থ্য নিয়ে, এই কথা আগেও বলেছি দুজনেরই দ্বিতীয় সমাসীন পরীক্ষা সামনে ছিলো এরই মধ্যে যদি কোনো কারণে রোগ দেখা দেয় তবে আর নিস্তার নেই, আর অন্য দিকে আমার মনের আবেগ তার কথার কথা রাখা, তাকে নিয়ে বৃষ্টি ভেজা, চোখে চোখে কথা বলা। শেষ পর্যন্ত আমি না বলে পারলামনা যে 'আমি আসছি'। অনেক সময় অপেক্ষা করার পর তার প্রতুত্তর আসলো "আমি যাবো না।" যে আমার মুখে হ্যা শব্দটা শোনার জন্য এত খন অনুনয় বিনয় করছিলো, আমি না বলাতে কাতরতা প্রকাশ করছিলো আর এখন আমি হ্যা বলার পর সে না বলছে, আসতে হবে না তোমার এটা এক্কেবারেই অবাক হওয়ার মত কথা কিন্তু আমি অবাক হইনি তখন কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সে অভিমান করেছিলো আর ওই সময়ে আমার উপর  তার রাগ অভিমান করা টা খুবই স্বাভাবিক করণ ভালোও তো অনেক বাসত আমাকে। আমি মনে করি যারা ভালোবাসে তারা অভিমান করতে পারে। যদিও আমি জানতাম যে ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজে এতটা পথ মটর সাইকেলে চাপিয়ে যাওয়া সত্যিই খুব কঠিন, তবুও তার প্রতি আকৃষ্টতা ও অগাধ ভালোবাসার টানে আমি বলে উঠেছিলাম," আমি আসছি তুমি বেরও আর নাইবা বেরও আমি তোমার বাড়ির কাছে গিয়ে ফোন করবো আর বলেছিলাম আমি এতোটা পথ ভিজতে ভিজতে আসবো তার পরও যদি তুমি না বেরও এটা অত্যন্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার তোমার।" একটু বাদেই দেখি মোবাইলে ম্যাসেজ আসলো "আসো আমি রেডি হই।" আমি বেরিয়ে গেলাম একটানা আধ ঘণ্টা মটর সাইকেল চালানোর পর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পৌছালাম তার বাড়ি, সারা শরীর জলে ভিজা তাকে কল কলরব সাথে সাথেই বেরিয়ে আসলো সে। কোণ কথা না বলেই মটর সাইকেলে বসে পেছন থেকে জরিয়ে ধরেছিল আমার কম্পমান দেহটি আমিও কোনো কথা বলতে পারলামনা। ঝিরঝির বৃষ্টির বিকালে জন শুন্য পথ দিয়ে শুধু এগিয়ে যাচ্ছিলাম দুই প্রেমিক প্রেমিকা। নিবিড় নিস্তব্ধতা ভাঙ্গার চেষ্টায় আমি কিছু বলতে চাওয়াতে সে আমার কথা শুনতে না শুনতেই বলে উঠেছিল, " তোমার জন্য আমার চোখের কাজল সব নষ্ট হলো" কথাটা বলেই আমার পিঠে মৃদু আঘাত করলো। যদিও আমি সম্পূর্ণই নির্দোষী ছিলাম আর সমস্ত কৃতকর্মের জন্য দায়ী ছিল বৃষ্টির জল গুলো তবুও আমাকে দোষী সাব্যস্ত করাতে আমি কোনো আপত্তি না জানিয়ে মাথা নিচু করে দোষ স্বীকার করেছিলাম। নারীর কোমল হৃদয়ের কথা বুঝতে পেরেছিলাম সেদিন যে এত শত চিন্তাধারা, এত সুন্দর মুহূর্ত, এমন এক ঐতিহাসিক মিলনের মধ্যেও তার চিন্তা ছিলো শুধু তার কাজল আর সাজগোজ নিয়ে। আবার বলে উঠলো, " দেখতো কেমন কালো হয়ে গেল পুরো মুখটা, সব তোমার জন্য।" মটর সাইকেল আস্তে আসতেই চালাচ্ছিলাম একটুখানি ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ' প্রবল বেগে হাওয়া বইতে থাকার ফলে খোলা চুল গুলো তার চোখে মুখে আঁচড়ে পরছিল, কাজল টানা চোখ দুটোতে কত কি যে অলৌকিক রহস্য লুকিয়ে ছিলো তা এক পলকে দেখে নিয়েছিলাম, আজও আমার চোখে স্পষ্ট ভাসে তার নিষ্পাপ, পবিত্র চোখ দুটো যেন সাগরের চেয়ে অনেক বেশি গভীর। ওই চোখ দুটি এক মুহূর্তে যেন কত কথা বলে গেছিল আমায় আর তার ভেজা চুল গুলো আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল তার মুখের উপর থেকে সব মিলিয়ে আমার স্বপ্ন কন্যার মতো দেখাচ্ছিল তাকে। আমি সব কিছুই বুঝতে পেরেছিলাম যে সে চাইছিল আমি পেছন ফিরে একবার তাকে তাকিয়ে দেখি কিন্তু কিছু না বোঝার ভান করে তাকে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলেছিলাম, " কাজল নষ্ট হওয়ার যখন এতোই ভয় ছিল 'ওয়াটার প্রুফ' কাজল লাগিয়ে আসতে।" এই কথা শোনার সাথে সাথেই দুটি মৃদু আঘাত করলো আমার পিঠে। একটুখানি নিরবতার পর আমি বলেছিলাম," আচ্ছা মোহিনী এই বৃষ্টিতে কোথায় যাবে কি করবে কিছুই তো বুঝলাম না আর তুমি নিজেই..." আমার কথা শেষ হতে না হতে সে আমাকে আরো জোরে ধরে বলেছিল, "আমার জন্য তোমার অনেক কষ্ট হলো না আজ?" আমি বলেছিলাম, "না তো।"
এসব কথা বার্তার মধ্যেই অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছিলাম।
বৃষ্টির জলের মতোই তার মুখে থেকে অবিশ্রান্ত শব্দ ঝরছিল, বোঝা কঠিন বাস্তব অবাস্তব মিলিয়ে কত রকমের কথা আমিও শুনেই যাচ্ছিলাম। চলতে চলতে রাস্তার বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি একটি ছোট নদী আর ডান দিকে বিশাল পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ের থেকে ধোঁয়া। আমি মটর সাইকেল দ্বার করিয়ে তাকে সেটা দেখালাম। সে হঠাৎ বলে উঠেছিল, " জানো বাড়িতে আমার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসছে, অনেক ভালো ভালো জায়গা থেকে। একটা ছেলে তো সুইজারল্যান্ড এ চাকরি আসল বাড়ি কোলকাতা জাতিতে ব্রাহ্মণ আর একটা....।" আমি বলেছিলাম, " আচ্ছা বাবা ভালো ছেলে পেয়েছ যখন বিয়ে করে ফেলো।" সে বলেছিল, "দেখো আমি মজা করছিনা তোমার সাথে, সত্যিই বাড়ি থেকে অনেক চাপ দিচ্ছে আমায়"। আমি বলেছিলাম, " আর কিছু দিন অপেক্ষা কর আমি তোমার বাড়ি যাব তোমার মায়ের কাছ থেকে তোমার হাত চাইতে"। সে বলেছিল, "মা তোমার সাথে কখনোই আমার বিয়ে দেবেনা আর আমি মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো দিনও তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা।" আমার অশ্রুধারা বয়ে চলছিল আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে কাতর ভাবে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "কিন্তু কেন হতে পারে না আমাদের বিয়ে আর তোমার মাই বা কেন..?" শেষে সে বলেছিল, কারণ আমি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে আর তুমি সূদ্র। আমি বলেছিলাম," তুমি আজও এসব মান?"  সে বলেছিল, "আমি মানি না কিন্তু সমাজ মানে"।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সে কেনো বেশ্যা?

কলঙ্কিনীর প্রেম

নষ্ট মেয়ে